সেমিনারে আলোচকরা
“প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির অভাবে জুলাই আন্দোলনে নারীদের অবদানের ইতিহাস ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে”
প্রকাশিত: ২৫ জুন ২০২৫, ২০:২৬

‘‘জুলাই অভ্যুত্থানে দেড় দশক ধরে জাতির ঘাড়ে চেপে থাকা জুলুম নির্যাতনের অবসান হয়েছে। এই বিপ্লবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারী শিক্ষার্থীরা সামনের সারিতে ছিলেন। এই বিপ্লবে সূচনা নারীদের হাত ধরেই হলেও প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতির অভাবে সেই ইতিহাস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।’’
বুধবার (২৫ জুন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের আব্দুল্লাহ ফারুক মিলনায়তনে ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ)-এর উদ্যোগে "জুলাই ঘোষণাপত্র: নারীদের ভাবনা" শীর্ষক এক সেমিনারে এ মন্তব্য করেন আলোচকরা।
আলোচনা সভায় গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের মুখপাত্র আশরেফা খাতুন বলেন, “আমরা যদি দেখি, জুলাই আন্দোলনের আগে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার কাউকে দমন-পীড়ন চালিয়েছে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ ট্যাগ দিয়ে। রাজাকার শব্দটি মানুষকে নির্যাতনের বৈধতা ছিল। এমনকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা মতবিরোধী হওয়ার কারণেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানদের রাজাকার ট্যাগ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের পরে এই ধারা চালু হয়। এ দেশে এক ধরনের ইসলামোফোবিয়া বিরাজ করেছে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘জুলাই রেভ্যুলশনের কথা যদি চিন্তা করি, তবে সেটার সূচনা হয়েছে ১৪ জুলাই রাতে। যার নেতৃত্ব ছিল নারী শিক্ষার্থীদের হাতে। হ্যাঁ, জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এক দিনে তৈরি হয়নি, তবে এর সূচনা হয়েছে ১৪ জুলাই রাতেই। সেখানে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। হাসিনার পতন নারীদের হাত ধরেই শুরু হয়েছে। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর থেকে নারীদের সেই ইতিহাস আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে। আমরা নারীদের এই অবদানের স্বীকৃতি চাই। আমাদের নিজেদের অবদানকে গ্লোরিফাই করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু ১৪ জুলাইয়ের নারীদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে হবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীনতার আগে বা পরে—এ দেশে ‘জুলাই আন্দোলন’-এর মতো এত বড় একটি বিপ্লব আর হয়নি। কিন্তু যদি বিপ্লবের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকে, তাহলে ত্রিশ বছর পর জুলাই বিপ্লবের অবদান মানুষ ভুলে যাবে। আশ্চর্যের বিষয়, যেসব রাজনৈতিক দল ফ্যাসিবাদী আমলে ব্যাপকভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তারাই এখন জুলাই স্বীকৃতির দাবি তুলছে না। সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকলে জুলাই আন্দোলনে থাকার কারণে এই যোদ্ধাদের ভবিষ্যতে হয়তো জেলে যেতে হতে পারে। তাই অন্তবর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই—জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দ্রুত প্রদান করুন।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র শিক্ষার্থী নওশীন নওয়ার জয়া বলেন, “জুলাই ঘোষণাপত্রের গুরুত্বটা আমাদের বুঝতে হবে। এক বিপ্লবে যাদেরকে কেউ নোটিশই করতে পারেনি, তাদের নিয়ে আমাদের কাজ করা প্রয়োজন। জুলাইয়ের অবদান কোনো একক গোষ্ঠির ছিল না। এটি ছিল সব শ্রেণির মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। কিন্তু আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে ‘মাস্টারমাইন্ড’সহ নানা ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়ে বিভক্তি ছড়ানো হয়েছে। সেখানে নারীদের অবদানের ইতিহাস মুছে ফেলা হচ্ছে। জুলাই নারীদের আলাদা স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়নি। যদিও বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে এনসিপি (তৎকালীন জাতীয় নাগরিক কমিটি) ঘোষণাপত্র নিয়ে কাজ করেছিল, সেটি শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেনি। এখন অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। অন্তবর্তী সরকারের উচিত জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করা।”
ফাউন্ডার একশন এন্ড অ্যাক্টিভিস্ট এবং ফাউন্ডার কমিউনিটি ট্রান্সফরমেশনের আহ্বায়ক নাফিসা ইসলাম সাকাফি বলেন, “প্রতিটি ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের নারীদের অগ্রণী ভূমিকা থাকার পরেও তাদের অবদান ইতিহাসে তেমনভাবে রাখা হয়নি। দেখা যায়, তখন নারীদের ভূমিকা ছোট করে দেখা হয়েছে। এত বড় বিপ্লবের পরেও আজকে জুলাই যোদ্ধারা বিভিন্নভাবে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। অথচ এ দেশের প্রতিটি আন্দোলনেই নারীদের অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। জুলাইয়ে জাতি দেখেছে কীভাবে মেয়েরা রাস্তায় নেমে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নারীরা যখন ভিকটিম হয়, তখন তাকেই আবার ব্লেম করা হয়। নারীদের যদি তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান না দেওয়া হয়, তাহলে তা একটি বড় জুলুম হয়ে যাবে। আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যেন জুলাইয়ের পর তাদের বারবার রাস্তায় নামতে না হয় নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য।”
সেমিনারে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব সাগুফতা বুশরা মিশমা, ঢাবি ইসলামী ছাত্রসংস্থার সভানেত্রী সাবিকুন্নাহার তামান্না, আপ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় সদস্য ফারজানা আক্তার, এক্টিভিস্ট ও ‘একশন ফর কমিউনিটি ট্রান্সফর্মেশন (এক্ট)’-এর ফাউন্ডার উম্মে সালমা প্রমুখ।
টিডিডি/ এএইচআর