আবেদনের যোগ্যতা নেই, অথচ ১০ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি 

প্রকাশিত: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৩৩

Thumbnail
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে সাধারণত শর্ত থাকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ন্যূনতম জিপিএ ৪.০০ (৫.০০ স্কেলে) এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে কমপক্ষে সিজিপিএ ৩.৫০ (৪.০০ স্কেলে) থাকতে হবে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগে মেহেদী উল্লাহকে নিয়োগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেই শর্ত শিথিল করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল।
 
২০১৫ সালের ১২ মে প্রকাশিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশেষ যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রার্থীর ফলাফলের যেকোনো একটির আংশিক শিথিল করা যেতে পারে। সাধারণত উচ্চতর ডিগ্রি (পিএইচডি), আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে প্রথম লেখক হিসেবে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধকেই বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞপ্তিতে বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে দেখানো হয়— ফোকলোর বিষয়ে স্বীকৃত প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ, স্বীকৃত জার্নালে একক নামে প্রকাশিত প্রবন্ধ অথবা স্বীকৃত সংস্থা কর্তৃক জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তি।
 
এই বিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে, অনার্সে ৩.৩১ সিজিপিএ পাওয়া মেহেদী উল্লাহ বেহুলা বাংলা নামের বেসরকারি প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত "ফোকলোরের প্রথম পাঠ" নামে একটি গ্রন্থ এবং জেমকন সাহিত্য পুরষ্কার প্রাপ্তিকে তিনি বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে দেখান। অনুসন্ধানে উঠে আসে, গ্রন্থটির অধিকাংশ লেখাই বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রকাশিত ‘লোকসংস্কৃতি’ গ্রন্থ থেকে কপি-পেস্ট করা। জেমকন সাহিত্য পুরষ্কারটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেমকন গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান আজকের কাগজ ও কাগজ প্রকাশনী ২০০০ সাল থেকে এই পুরস্কারটি প্রদান করে থাকে। বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে তিনি যে গ্রন্থ এবং পুরষ্কার প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করেছেন দুটির কোনোটিই জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের নয় বরং দুটিই  বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। 
 
অভিযুক্ত এই শিক্ষক এর আগেও তৎকালীন উপাচার্য মোহিত উল আলমের পিএস খন্দকার এহসান হাবিবের ভাই হওয়ার সুবাদে (পরবর্তীতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গরু বলার কারণে বহিষ্কার হন) নিয়োগ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। সেবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ১জন শিক্ষক নিয়োগের কথা উল্লেখ থাকলেও, তার ভাই খন্দকার এহসান হাবিব প্রভাব খাটিয়ে তার ভাই মেহেদী উল্লাহসহ এক পদের বিপরীতে দুজনের সুপারিশ করান। কিন্তু পরবর্তীতে সিন্ডিকেটে মেহেদী উল্লাহর নিয়োগ বাতিল করা হয়। এই নিয়োগ বাতিল হওয়ার পরেই ২০১৫ সালের মার্চ মাসে অভিযুক্ত এই শিক্ষক 'ফোকলোরের প্রথম পাঠ' বইটি প্রকাশ করেন। 
 
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিপূর্বে ঘটা অনিয়ম-দুর্নীতি উদঘাটনে গঠিত সত্যানুসন্ধান কমিটির নিকট লিখিত অভিযোগকারী চাকরি বঞ্চিত প্রার্থী আশরাফুল ইসলাম জানান, “নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে অনার্সে ন্যূনতম সিজিপিএ ৩.৫০ থাকার কথা থাকলেও নির্বাচিত প্রার্থীর সিজিপিএ ছিল ৩.৩১। তাঁর পুরস্কার কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত নয়, বরং একটি কোম্পানি থেকে পাওয়া। দেশীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত জার্নালে তাঁর কোনো প্রকাশনা নেই, বরং টাকার বিনিময়ে করা প্রকাশনা দেখানো হয়েছে। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে এ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে আমাকে চরম বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। আমি অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েও বঞ্চিত হয়েছি। আমি সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার দাবি করছি।”
 
অভিযোগ রয়েছে, নিয়মকে পায়ে মাড়িয়ে শিক্ষক হয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। নিজে শিক্ষক হওয়ার পর পছন্দের শিক্ষার্থীকে শিক্ষক বানাতে নম্বর টেম্পারিংয়ে জড়ানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পুরো ফলাফল ঘেটে দেখা যায়, প্রদিতি রাউত প্রমাকে নিয়োগ দিতে স্নাতকে সিজিপিএ ৩.৫০ বা এর বেশি পাওয়া শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তরে ৩.৫০ এর কম দেখানো হয়েছে। প্রমা এবং আরেকজন শিক্ষার্থীকে যথাক্রমে ৩.৫০ ও ৩.৭০ দেওয়া হলেও, দ্বিতীয় জন স্নাতকে ৩.৫০ এর কম পাওয়ায় শর্ত পূরণ করতে পারেননি। ফলে প্রমা ছাড়া অন্য কেউ আবেদনই করতে পারেননি। নিয়োগকালীন সময়ে মেহেদী উল্লাহ ছিলেন ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক এবং উপাচার্য সৌমিত্র শেখরের আস্থাভাজন। প্রভাব খাটিয়ে তিনি প্রমার নিয়োগ বাগিয়ে নেন। প্রমার নিয়োগপত্র সংক্রান্ত কাগজপত্র সাবেক ভিসি সৌমিত্র শেখরের শয়নকক্ষে পাওয়া যায়। 
 
অভিযোগকারীরা জানান, প্রদিতি রাউত প্রমার প্রথম চার সেমিস্টারের ফলাফল ভালো ছিল না। পরে ১ম ও ২য় সেমিস্টারের কয়েকটি কোর্সে বিশেষ সুযোগে (স্পেশাল ইমপ্রুভ) আবার পরীক্ষা দিয়ে নম্বর বাড়ানো হয়। সব মিলিয়ে অষ্টম সেমিস্টারে গিয়ে তিনি কাটায়-কাটায় সিজিপিএ ৩.৫০ উঠান। এছাড়াও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, কিছু কোর্সে তিনি আগেই প্রশ্ন পেয়েছিলেন।
 
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোঃ সুজন আলী, সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. উজ্জ্বল কুমার প্রধান, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান ও অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এবং সর্বশেষ সত্যানুসন্ধান কমিটির নিকট লিখিত অভিযোগ জমা দেন।
 
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময়ও ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক হিসেবে শিক্ষার্থীবান্ধব না হয়ে তিনি আন্দোলনে বাধা দেন, গ্রাফিতি অঙ্কনে বাঁধা দেন এবং শিক্ষার্থীদের উপর মারমুখী ভূমিকা নেন। ভিডিও ফুটেজেও এ অভিযোগ প্রমাণ মেলে।
 
ইতিপূর্বে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ভিত্তিতে মেহেদী উল্লাহর চাকরি স্থায়ীকরণ স্থগিত ও শোকজ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
 
এ ব্যাপারে ড. মেহেদী উল্লাহর কাছে জানতে চাইলে বলেন, আমি বিজ্ঞপ্তির সম্পূর্ণ শর্ত পূরণ করেই আবেদন করেছি। নিয়োগ পরিক্ষায় প্রথম হয়ে প্রভাষক স্থায়ী পদে নিয়োগ পাই। আবেদনে বিশেষ যোগ্যতার এমন শর্তের ব্যাপারে প্রশাসন ভালো বলতে পারবে। 
 
তৎকালীন উপাচার্যের পিএস খন্দকার এহসান হাবিব তার ভাই নয় বলেও দাবি করেন তিনি। 
 
নম্বর টেম্পারিংয় অভিযোগ অস্বীকার করে মেহেদী উল্লাহ বলেন, ‘স্নাতকোত্তরে দুই সেমিস্টারে পাঁচটি করে মোট দশটি কোর্স ছিলো শিক্ষার্থীদের, সেখানে প্রথম সেমিস্টারে আমার একটি কোর্স ছিলো। 
 
অপরদিকে একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের স্নাতকে নম্বর টেম্পারিংয়ের অভিযোগসহ বিভিন্ন ঘটনায় একাধিকবার তৎকালীন প্রক্টর-ছাত্র উপদেষ্টার মীমাংসা করার সত্যতা রয়েছে।
 
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, এসব বিষয় নিয়ে একাডেমিক অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি কাজ করছে। রিপোর্ট পেলেই আমরা বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবো।
 
এ বিষয়ে জানতে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহিত উল আলমের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
 
 
টিডিডি/ এএইচআর