দ্রুত ডাকসু তফসিল চায় ছাত্রসংগঠনগুলো, একাট্টা দাবির ভিড়ে আলাদা অবস্থানে ছাত্রদল
প্রকাশিত: ২০ জুন ২০২৫, ২১:২০

দীর্ঘ ছয় বছরের অপেক্ষা ও শিক্ষার্থীদের নানা আন্দোলন সংগ্রামের পর অবশেষে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে নির্বাচন হলেও তা অংশগ্রহণ সীমাবদ্ধতা ও নানা জটিলতার কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়ে। এরপর থেকে স্থবির হয়ে পড়ে ডাকসু।
ছাত্র-জনতার জুলাই গণভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে নতুন করে প্রাণ পেতে যাচ্ছে এই ঐতিহাসিক ছাত্রসংসদ। গত ১৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের বিশেষ সভায় ১০ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। তার নেতৃত্বে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের প্রত্যাশা করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে ইতোমধ্যে নির্বাচনী আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলো নতুন করে সংগঠন পুনর্গঠন ও প্রচার-প্রচারণার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন নির্বাচনের জন্য নিজ নিজ কৌশল নির্ধারণে কাজ করছে।
একইসাথে অধিকাংশ ছাত্রসংগঠন দ্রুত তফসিল ঘোষণার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা মনে করছেন, দীর্ঘদিন পর নির্বাচন কমিশন গঠন একটি আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ এবং এখন দ্রুত ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন জরুরি। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংসদ—সবাই প্রশাসনের দীর্ঘসূত্রতার সমালোচনা করলেও নির্বাচন বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে ডাকসু নির্বাচনের জন্য সিন্ডিকেটে নির্বাচন কমিশন গঠনসহ বেশকিছু সিদ্ধান্ত হলেও ছাত্রদল এই মুহূর্তে নির্বাচনের পরিবেশকে উপযুক্ত মনে করছে না। বর্তমান প্রশাসনের অধীনে নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকার অভিযোগ সংগঠনটির। সংগঠনটির মতে, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাহীনতা, সাম্প্রতিক সহিংসতা ও প্রশাসনের ব্যর্থতা অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদের দাবি, আগে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করেই ডাকসু নির্বাচন দেওয়া উচিত।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিঠি পেলেই কাজ শুরু করবে নির্বাচন কমিশন। ডাকসুর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিরাপত্তা জোরদারে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় মোতায়েন থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ছয়টি প্রধান প্রবেশদ্বারে চেকপোস্টের মাধ্যমে তল্লাশি অভিযান চালানো হবে, যেখানে প্রক্টরিয়াল টিমের পাশাপাশি আনসার ও সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা অংশ নেবেন।
এছাড়া, ভবঘুরে উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করবে পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল টিম এবং পুনর্বাসনের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চেয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিতে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সভার পাশাপাশি সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যা বাড়ানো, নষ্ট ক্যামেরা সংস্কার এবং রাতের আলোকসজ্জা জোরদার করা হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরেও পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হবে বলে জানানো হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেন, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তিনি।
ডাকসুর নির্বাচন কমিশনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন দ্যা ঢাকা ডায়েরিকে বলেন, আমরা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাইনি। চিঠি পেলে সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পরামর্শে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করব।
যা ভাবছে শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনগুলো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম আবির বলেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত হয় সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ক্যাম্পাসে প্রশাসন ছাত্রদের মতামত চাইলে ছাত্রদল, শিবির বা অন্যকোনো সংগঠনের নেতাদের মতামত নেয়। কিন্তু তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতা না। তাদের বক্তব্যে ছাত্রদের স্বার্থের চেয়ে সেই দলের স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পায়। সকল সংগঠনের যুক্তিসংগত অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেই ডাকসু ছাত্রসমাজের প্রকৃত কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী এবি জুবায়ের বলেন, অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রসংসদ নির্বাচন তো আমাদের মৌলিক চাওয়া-পাওয়াগুলোর অন্যতম। ছাত্রসংসদ দলীয় লেজুড়বৃত্তির ঊর্ধ্বে গিয়ে শিক্ষার্থীদের গঠনমূলক রাজনৈতিক চর্চার অন্যতম সেরা মাধ্যম, একইসাথে ফ্যাসিস্ট তৈরি হওয়ার পথেও অন্যতম অন্তরায়৷ এসব দিক বিবেচনায় যেকোনো শিক্ষার্থীবান্ধব সংগঠনেরই উচিত ডাকসু কার্যকর করতে প্রশাসনকে সহায়তা করা। ঢাবিতে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সংগঠন ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে, ছাত্রদলের কাছেও ডাকসুর প্রশ্নে পজিটিভ অবস্থান আশা করি।
স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংসদ এর আহ্বায়ক জালালুদ্দিন মোহাম্মদ খালিদ বলেন, দেরিতে হলেও ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। চিফ রিটার্নং অফিসার অধ্যাপক জসিম স্যারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন আগামী রবিবার প্রশাসনের সঙ্গে মিটিং করে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। আশা করি এই প্রশাসন আগামী জুলাই মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করবে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ও নিরাপদ শিক্ষাঙ্গনের জন্য ডাকসু নির্বাচন সময়োপযোগী ও সবার প্রত্যাশিত। কোনো অজুহাতে এই নির্বাচন উপেক্ষা করা উচিত নয়। প্রতি বছর নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও নেওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, গঠনতন্ত্র সংস্কারের পরও ডাকসুর ওপর প্রশাসনিক আধিপত্য বজায় রয়েছে, যা অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনের মতের পরিপন্থী। তোফাজ্জল ও সাম্য হত্যাসহ সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার বিচারহীনতা এবং প্রশাসনের ব্যর্থতা ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা প্রশ্নে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এসব কাটিয়ে উঠে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সর্বজনগ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজনই এখন সময়ের দাবি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় দশ মাস পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠন একটি আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে—এটাই আমাদের জোরালো দাবি। নির্বাচন যত বেশি দেরি হবে, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ততই সংকটময় হবে এবং শিক্ষার্থীরা আরও দীর্ঘ সময় বঞ্চনার শিকার হবে, ফলে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে; যেটা সমাধান করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান বলেন, দেরিতে হলেও কমিশন গঠনকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অকারণ দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। এখন আমাদের প্রত্যাশা, নির্বাচন কমিশন দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। কিছু ছাত্রসংগঠন নানা অজুহাতে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। আমরা মনে করি, তারা শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রতিবছর ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও ফ্যাসিবাদী শাসনামলে তা ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল। আমরা তখনও ডাকসুর দাবিতে আন্দোলন করেছি। অথচ ফ্যাসিবাদের পতনের পর দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান প্রশাসন বিলম্ব করছে, যা হতাশাজনক।
তিনি আরও জানান, ডাকসুর প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন স্যার আমাদের সঙ্গে বসার আগ্রহ দেখিয়েছেন। আমরা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছি—আগামী ৫ দিনের মধ্যে তফসিল ঘোষণা না হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে আমরা আবারও আন্দোলনে নামব।
ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, অভ্যুত্থানের পরবর্তীতে বর্তমান প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা গভীর উদ্বেগজনক। বিগত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত আবু বকর ছাড়া আর কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। এমনকি জুলাই আন্দোলনের সময়ও কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, বর্ষবরণের সময় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিষিদ্ধ সংগঠনের কর্মীরা ফ্যাসিবাদের প্রতীক পুড়িয়েছে, ক্যাম্পাসসংলগ্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে, এবং ক্যাম্পাসে অবিস্ফোরিত ককটেলও পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় প্রশাসনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে।
নাহিদুজ্জামান শিপন আরও বলেন, ডাকসুতে যেহেতু আবাসিক ও অনাবাসিক উভয় শিক্ষার্থীরাই ভোটার হবেন, তাই এতটা ভঙ্গুর নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে বিশেষ করে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি নিয়েই প্রশ্ন থেকে যায়। ছাত্রদল শুরু থেকেই ডাকসুর দাবিতে সক্রিয় এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতের পক্ষে রয়েছে। তবে বর্তমানে ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত না করে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া প্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে করছি।
টিডিডি/ এএইচআর/ এমবিইউ/