সিপিআর বাঁচাতে পারে হার্ট অ্যাটাকের লাখো প্রাণ
প্রকাশিত: ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০০:৩১

দেশে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে (হৃদ্যন্ত্র হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া) মৃত্যুর হার ভয়াবহভাবে বাড়ছে। আক্রান্ত রোগীর জীবন বাঁচাতে প্রথম পাঁচ মিনিট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়টায় আশপাশের সাধারণ মানুষ যদি সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) দিতে পারেন, তাহলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। তাই সবাই যেন জরুরি মুহূর্তে ‘প্রথম পাঁচ মিনিটের ডাক্তার’ হয়ে উঠতে পারে। সামান্য একটি পদ্ধতি সিপিআর জানা থাকলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের লাখো প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কর্মস্থল সবখানে সিপিআর পদ্ধতির প্রশিক্ষণ ছড়িয়ে দেওয়া দরকার বলেও মত তাদের।
মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে বিশ্ব হার্ট দিবস উপলক্ষে সিপিআর প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিয়ে তারা এসব কথা বলেন।
সামরিক চিকিৎসা সার্ভিস মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএমএস) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী মো. রশিদ-উন-নবী বলেন, উন্নত দেশগুলোতে স্কুল লেভেলেই সিপিআর শেখানো হয়। কখন কার দরকার হবে, কেউ জানে না। সবাই সিপিআর জানলে অন্তত একজনকে বাঁচিয়ে ডাক্তারখানায় পাঠানোর সুযোগ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ডাক্তাররা ভুল করলে তা বলা অবশ্যই দরকার। কিন্তু তাদের কঠোর পরিশ্রম ও ভালো কাজগুলোও সংবাদে আসা উচিত। এতে স্বাস্থ্যকর্মীরা অনুপ্রাণিত হবেন, আর সমাজও সঠিক বার্তা পাবে। অনেক সময় আমরা ১০ মিনিটের সাক্ষাৎকার দিই, কিন্তু ৩০ সেকেন্ড কভার হয়, সেটাতেও শুধু নেতিবাচক অংশটাই তুলে ধরা হয়। সমাজে যখন ইতিবাচক সংবাদ থাকে, তখন মানুষ তেমন মনোযোগ দেয় না। অথচ ভালো খবর দিলে ডাক্তাররা স্বীকৃতি পাবেন, কাজে আরও উৎসাহী হবেন।
রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, কুর্মিটোলা হাসপাতাল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি পূর্ণাঙ্গ সিভিল হাসপাতাল। এটি শতভাগ বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত। ২০১২ সালের ১৩ মে উদ্বোধনের পর থেকেই আমরা সাধারণ মানুষের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই হাসপাতালের লক্ষ্য হল সর্বোচ্চ মানের সেবা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে দরিদ্র, প্রান্তিক ও দুস্থ মানুষের জন্য এটিকে নির্ভরযোগ্য ভরসাস্থল হিসেবে গড়ে তোলা।
তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ (ওপিডি) ও ডায়াগনস্টিক পরিষেবাগুলো ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্য কোনো হাসপাতাল যেখানে ২৪/৭ প্যাথলজিক্যাল সেবা দিতে পারেনি, কুর্মিটোলা হাসপাতাল সেখানে দিনরাত নিরবচ্ছিন্নভাবে এই সেবা দিচ্ছে। এছাড়াও কেমোথেরাপি, ছোট-বড় অস্ত্রোপচার ও গাইনোকোলজি বিভাগেও ২৪ ঘণ্টা সেবা চালু রয়েছে। বর্তমানে আমাদের হাসপাতালে ২০ শয্যার সিসিইউ ও ২০ শয্যার এসডিইউ চালু আছে। তবে সবচেয়ে বড় অর্জন হতে যাচ্ছে নতুন ৫০ শয্যার আইসিইউ, যা আগামী ১৬ ডিসেম্বর উদ্বোধন করা হবে। এর পাশাপাশি ৬ষ্ঠ তলায় ২০ শয্যার এনআইসিইউও স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে। দরিদ্র রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস সেবা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের ১০০ শয্যার ডায়ালাইসিস ইউনিট রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত প্রায় ৬০ জন রোগী এই সেবা নিচ্ছেন। এর জন্য নেওয়া হয় মাত্র ৪৭০ টাকা, যা সারা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। দরিদ্র মানুষের ভিড় বাড়ায় আমরা আরও ৩০ শয্যা বাড়াচ্ছি। নতুন ইউনিট চালু হলে প্রতিদিন অতিরিক্ত ১০০ জন রোগী ডায়ালাইসিস সুবিধা পাবেন।
তিনি বলেন, আমরা স্বাস্থ্যসেবা ডিজিটালাইজেশনে এগিয়ে গেছি। কুর্মিটোলা হাসপাতাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ বিভাগের মধ্যে প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই সেবা চালু করছে। ইতোমধ্যে অনলাইন রিপোর্টিং সেবা চালু হয়েছে। রোগীরা ঘরে বসেই রিপোর্ট সংগ্রহ করতে পারছেন। অনলাইন টিকিট সংগ্রহের সুবিধাও রয়েছে। শিগগিরই অনলাইন ফি পেমেন্ট চালু হবে, যাতে মানুষজন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে না হয়। আগামী তিন মাসের মধ্যে একটি প্যাভিলিয়ন চালু করা হবে, যেখানে সব সেবা এক ছাদের নিচে পাওয়া যাবে। আমাদের কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশন সেন্টার বা ক্যাথ ল্যাবে অধ্যাপক মহসিনের নেতৃত্বে প্রতিদিন ১০টি করোনারি ইন্টারভেনশন সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। ক্যানসার সেন্টারে কেমোথেরাপি সেবা চলছে, শিগগিরই রেডিওথেরাপি মেশিন আসছে। গ্যাস্ট্রোলজি বিভাগ আগে ছিল না, কিন্তু এখন অধ্যাপক কুবরিয়ার নেতৃত্বে নতুন সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। এটি দেশের অন্যতম আধুনিক গ্যাস্ট্রো সেন্টার হবে। লেভেল ৮-এ আরও ১০০ শয্যা নির্মাণাধীন আছে।
স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সেবা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে প্রতিদিন ৫ থেকে ৭টি সিজারিয়ান হতো। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ৩০টিতে। তবে আমরা প্রথমে সিজারিয়ান না করে স্বাভাবিক প্রসবকে গুরুত্ব দিই। এই বিভাগও ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। রোগী ও তাদের স্বজনদের জন্য পরিচ্ছন্ন ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমাদের টিম সর্বদা রোগী, বিশেষ করে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণের পাশে আছে। আধুনিক আইসিইউ, এনআইসিইউ, ডায়ালাইসিস ইউনিট ও বিশেষায়িত বিভাগগুলো চালু হলে কুর্মিটোলা হাসপাতাল দেশের স্বাস্থ্যসেবায় একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করবে।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মহসীন আহমেদ বলেন, হার্ট অ্যাটাক হয় রক্তনালীতে ব্লক হলে। এতে ব্যথা হয়, কিন্তু রোগী হাসপাতালে যাওয়ার সময় পান। অন্যদিকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলো হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার মতো। তখন হার্ট থেমে যায়, পালস থাকে না, শ্বাস থাকে না। ৯–১০ মিনিটের মধ্যে মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি হয়। পৃথিবীতে এমন কোনো রোগ নেই যা পাঁচ মিনিটের মধ্যে জীবন কেড়ে নেয়। তাই সঙ্গে সঙ্গে সিপিআর শুরু করা ছাড়া বিকল্প নেই। হার্ট অ্যাটাক ধীরে ধীরে সময় দেয়, কিন্তু কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বিদ্যুতের মতো—এক মুহূর্তেই সব বন্ধ হয়ে যায়। তখন পাশে থাকা স্বামী, স্ত্রী, সন্তান বা সহকর্মীকেই ডাক্তার হয়ে উঠতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে তিনি চেইন অব সারভাইভাল’এর চারটি ধাপ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। প্রথম ধাপ, রোগী শনাক্ত করে সাহায্য চাওয়া। দ্বিতীয় ধাপ, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট নিশ্চিত হলে সিপিআর শুরু করা। তৃতীয় ধাপ, অন্তত ৩০ মিনিট ধরে সিপিআর চালিয়ে যাওয়া বা অ্যাম্বুলেন্সে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া। চতুর্থ ধাপ, হাসপাতালে পৌঁছে উন্নত চিকিৎসা শুরু করা। তার ভাষায়, সিপিআর মানে আসলে হার্টের পাম্পিং কাজটা হাতে করা—চাপ দেওয়া ও ছাড়ার মাধ্যমে ব্লাড সার্কুলেশন চালিয়ে যাওয়া।
তার মতে, স্কুল পাঠ্যক্রমে বিষয়টি যুক্ত করা জরুরি। এজন্য তিনি নবম শ্রেণির বইয়ে দুই পৃষ্ঠা সংযোজনের চেষ্টা করেছিলেন। তার বিশ্বাস, এর ফলে বাংলাদেশে বিশাল পরিবর্তন আসবে। বিদেশে স্কুলে স্কুলে সিপিআর শেখানো হয়। আমাদের ছেলে-মেয়েরা ইউটিউব দেখে অনেক কিছু শিখছে। পাঠ্যবইয়ে সিপিআর ঢুকিয়ে দিলে পুরো প্রজন্মই স্মার্ট হয়ে উঠবে, আশা প্রকাশ করেন তিনি।
হেলদি হার্ট হ্যাপি লাইফ অর্গানাইজেশনের সহযোগিতায় আয়োজিত কর্মশালায় আরও বক্তব্য রাখেন সিএমএইচ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের চিফ ফিজিশিয়ান জেনারেল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অধ্যাপক ডা. সায়েদা আলেয়া সুলতানা, হেলদি হার্ট হ্যাপি লাইফ অর্গানাইজেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু রেজা মো. কাইয়ুম খান ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি রাশেদ রাব্বি। সিপিআর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মহসীন আহমেদ।
এইচটি।