চট্টগ্রামের ১১জুলাই: পুলিশি হামলা, অবরোধ ও গার্ড অব অনারের ইতিহাস

প্রকাশিত: ১১ জুলাই ২০২৫, ২১:০২

Thumbnail
পুলিশের হামলায় আহত শিক্ষার্থীরা

২০২৪ সালের ১১ জুলাই আনুমানিক বেলা সাড়ে ৪টা থেকে সোয়া ৫টা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ 'বাংলা ব্লকেড' কর্মসূচী বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও চট্টগ্রামের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বটতলী রেলস্টেশন থেকে টাইগারপাস মহাসড়ক অবরোধের জন্য যান। সেখানে হঠাৎ আক্রমণ শুরু করে পুলিশ। এতে নারী শিক্ষার্থীসহ আহত হয় অন্তত ১০ শিক্ষার্থী। ঠিক তার পরের মুহুর্তে সেদিন ফুঁসে উঠেছিল চট্টগ্রাম নগরী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আন্দোলন শেষে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরলে তাদের প্রদান করা হয় গার্ড অব অনার।

২০২৪ সালের ১১জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের 'বাংলা ব্লকেড' কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুপুর দেড়টার শাটলে করে শহরে যায়। তারা দুপুর আড়াইটা থেকে চট্টগ্রাম নগরীর বটতলী রেলস্টেশনে অবস্থান করেন। পরে বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রেলস্টেশন থেকে টাইগারপাস মহাসড়ক অবরোধের জন্য এগিয়ে গেলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পথরোধ করে দাঁড়ায় পুলিশ এবং লাঠিচার্জ করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে।

পুলিশের বাঁধা ও লাঠিচার্জ:

আন্দোলনকারীরা টাইগারপাস মহাসড়ক অবরোধ করতে গেলে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে পুলিশের বাঁধার সম্মুখীন হন।

Media Image ১১ জুলাই ২০২৪ তারিখে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এভাবে ঘিরে রাখে পুলিশ

পুলিশ তাদের বাঁধা দিয়ে সামনে ও পিছনের দিক থেকে ঘিরে ফিলে। আন্দোলনকারীরা বাঁধা উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ পিছনের দিক থেকে তাদের উপর আক্রমণ চালায় এবং লাটিচার্জ শুরু করে। এতে নারী শিক্ষার্থীসহ অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হন সেদিন। একজন নারী শিক্ষার্থী সেদিন গুরুতর আহত হলে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

পুলিশি লাঠিচার্জের পর উত্তাল হয়ে উঠে  চট্টগ্রাম:

পুলিশি আক্রমণের পর সেদিন উত্তাল হয়ে উঠেছিল বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। পুলিশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমন করার পরও পুলিশি বাঁধা উপেক্ষা করে বিকেল ৫টার দিকে শহরের ২নং গেট অবরোধের জন্য এগিয়ে যান শিক্ষার্থীরা।

হামলার খবর পেয়ে শহরে অবস্থান করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থীরাসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা চারিদিক থেকে পঙ্গপালের মতো ছুটে আসে সেদিন। পুলিশের আক্রমণের পর সেদিন শত-শত শিক্ষার্থী নগরীর ২নং গেইট এলাকা অবরোধ করেন এবং তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। রাট ৮টা পর্যন্ত চলে তাদের আন্দোলন কর্মসূচী। ফলে সেদিন সড়কে সৃষ্টি হয়েছিল দীর্ঘ যানজটের।

Media Image পুলশের হামলার পর ২নং গেইট এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলে শিক্ষার্থীরা

অবরোধ হয়েছিল চট্টগ্রাম- খাগড়াছড়ি মহাসড়কও:

শহরে শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করার পর ক্যাম্পাসে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরাও এর প্রতিবাদ করেছিল। সেদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের ১ নং গেইট গিয়ে চট্টগ্রাম- খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, রাঙামাটি মহাসড়ক অবরোধ করেন।

Media Image শহরে শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে ১নং গেইট অবরোধ করেন চবি শিক্ষার্থীরা

সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে  বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেইট এলাকায় ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত এ অবরোধ কর্মসূচী পালন করেন। সেদিন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, “শহরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ হয়েছে শুনে নিজেদের অপরাধী মনে হয়েছিল। পরে সন্ধ্যায় আমরা ১নং গেইট অবরোধ করে শহরের হামলার প্রতিবাদ জানাই এবং আন্দোলনে শরীক হই।”

শহরে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে গার্ড অব অনার: “শহরে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অন্যায়ভাবে পুলিশ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর হামলা চালালে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, রাঙামাটি মহাসড়ক অবরোধ করে। সন্ধ্যা পৌনে ৭টা থেকে শুরু করে রাত ৯টা পর্যন্ত অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা জিরো পয়েন্ট এসে জড়ো হয়। শহর থেকে ছেড়ে আসা রাত সাড়ে ৮টার শাটল ট্রেনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসে পৌছালে ক্যাম্পাসে থাকা শিক্ষার্থীরা তাদের গার্ড অব অনার দিয়ে বরণ করে নেয়। সেদিন আন্দোলন থেকে ফিরে আসা ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মোঃ রায়হান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, "সেদিনের অনুভূতি বলে প্রকাশ করতে পারব না। আমরা শহরে পুলিশের হামলার শিকার হয়েও আন্দোলন করেছিলাম। এরপর রাতের শাটলে করে এসে যখন ক্যাম্পাসে নামলাম, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগ দেখে সব কষ্ট দূর হয়ে গিয়েছিল আমার"।

জুলাই আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করা ইতিহাস বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, "গতবছর এইদিনে চট্টগ্রাম নগরীর টাইগার পাসে প্রথম পুলিশের আক্রমণের শিকার হই। শুরুতে আমরা ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থী ছিলাম এবং আমাদের সামনে ঢাল হয়ে ছিলো ৮-১০ জন মেয়ে।আমাদের বিশ্বাস ছিলো মেয়েদেরকে পুলিশ আক্রমণ করবে না কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল ছিল। আমরা যখন পুলিশের বেরিকেড ভেঙে সামনে আগানোর চেষ্টা করি তখন মেয়েদেরকেসহ সবাইকে বেধড়ক পিটানো হয়। একটা মেয়ে খুব বাজেভাবে আহত হয় এবং তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হয়।”

তিনি বলেন, “ছাত্রদের উপর আঘাতের খবর যখন চট্টগ্রামের বাতাসে ছড়ায় তারপর থেকেই বীরচট্টলার ইতিহাস পাল্টানো শুরু করে। ঐদিন একই সাথে ক্যাম্পাসের ভাইবোনেরাও ১নং গেইট অবরোধ করে। আমরা যখন রাতে শাটলে ক্যাম্পাসে ফিরি তখন ক্যাম্পাসের ভাই-বোনগুলো যেভাবে আমাদের সম্মান প্রদর্শন করেছিলো আজীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে।"

টিডিডি/ এসআর