দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আর বিকল্প থাকে না—তখনও আমরা সেই অবস্থায় পৌঁছেছিলাম: মাভাবিপ্রবি উপাচার্য
প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১৯:০৫

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, সাহসিক ভূমিকা রেখেছেন শিক্ষকরাও। যখন ছাত্ররা বিপদের মুখে পড়েছে, তখন সাহসিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষকরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তেই সচেতন শিক্ষকসমাজ ছাত্রদের নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন।
বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) যখন শিক্ষার্থীরা হামলার শিকার হচ্ছিল, তখনও বেশ কিছু সাহসী শিক্ষক সামনে থেকে তাদের পাশে দাঁড়ান। আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে থেকে শুরু করে সরকার পতনের আগ পর্যন্ত-৫ আগস্ট পর্যন্ত-তাঁরা চালিয়ে গেছেন দীপ্ত প্রতিবাদ।
এমনই এক সাহসী শিক্ষক, ঢাবির জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল আজীম আখন্দ। গণঅভ্যুত্থানের পরে তিনি মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অভ্যুত্থানে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্যা ঢাকা ডায়েরির বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেছেন তিনি।
দ্যা ঢাকা ডায়েরি: জুলাই ২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলনে আপনি সরাসরি রাজপথে নেমেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হয়ে এই সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলেন? সেই সময়কার পরিস্থিতি ও অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
আনোয়ারুল আজীম আখন্দ: একজন শিক্ষক হিসেবে আমাদের প্রধান দায়িত্ব শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করা। আমি সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করি। তবে একইসাথে, যদি কোনো যৌক্তিক দাবি ওঠে বা অন্যায় হয়, সেটার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোও আমাদের নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করি। জুলাইয়ে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, আমরা শিক্ষকরা খুব কাছ থেকে তা প্রত্যক্ষ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে, আবাসিক এলাকায় অবস্থান করার সুবাদে আমরা শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনকে সমর্থন করি। এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা আমাদের ভেতর থেকে একটি তাগিদ সৃষ্টি করে- ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত।
আমি একা নই, আমাদের অনেক সহকর্মীও এই অবস্থান নিয়েছেন। যখন দেখি শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে তাদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তখন আমাদের ভেতর প্রতিবাদের তাগিদ আরও প্রবল হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই তখন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব মনে হয়েছে। তাই আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছি এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি।
দ্যা ঢাকা ডায়েরি: তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্তটি আপনার একাডেমিক ও প্রশাসনিক জীবনে কোনো চাপ, হুমকি বা প্রভাব ফেলেছিল কি? সে পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মোকাবেলা করেছেন?
আনোয়ারুল আজীম আখন্দ: আমি সরকারের বিপক্ষে গেলাম কিনা তার থেকে বড় হলো আমি ন্যায়ের পক্ষে রয়েছি কিনা। কারো বিরুদ্ধে গিয়েছি কিনা, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। অন্যায়টা যেই করুক, তা সরকার হোক বা অন্য কেউ, আমি সবসময় তার বিপক্ষে। শিক্ষক ও নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়া। ভয় ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি শিক্ষার্থীদের পাশে, ন্যায়ের পক্ষেই দাঁড়িয়েছি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আর বিকল্প থাকে না—তখনও আমরা সেই অবস্থায় পৌঁছেছিলাম। ভবিষ্যতেও যদি এমন পরিস্থিতি আসে, আমি ন্যায়ের পক্ষেই থাকব। কারণ, তখন যেই আত্মিক শক্তি পেয়েছিলাম, তা-ই আমাকে ন্যায়ের পথে অনড় রেখেছে।
দ্যা ঢাকা ডায়েরি: আপনি নব্বই সালের গণ-অভ্যুত্থান দেখেছেন এবং আন্দোলন করেছেন। এর সঙ্গে এবারের আন্দোলনকে কীভাবে তুলনা করবেন?
আনোয়ারুল আজীম আখন্দ: ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান ও ২৪ জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান মধ্যে প্রধান পার্থক্য প্রযুক্তিগত। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা তখন সম্ভব ছিল না। ৯০-এর আন্দোলন ছিল মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক, আর ২০২৪-এর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। তাছাড়া, ২৪ জুলাইয়ের আন্দোলনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়—যা ৯০-এ ছিল না, কারণ তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল না।
অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত দিক থেকেও এখনকার বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। কিন্তু ১৬-১৭ বছরের শাসনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ জমা হয়েছিল, যা আন্দোলনে রূপ নেয়। আমি ৯০-এ ছিলাম ছাত্র, এখন শিক্ষক; মানসিকতা বদলালেও প্রতিবাদের ভাষা বদলায়নি।
দ্যা ঢাকা ডায়েরি: আপনি বর্তমানে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সেই আন্দোলনের চেতনা ও অভিজ্ঞতা আপনার প্রশাসনিক দায়িত্বপালনে কীভাবে প্রভাব ফেলছে?
আনোয়ারুল আজীম আখন্দ: আন্দোলনের পর আমি মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি এবং এটিকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই। কারণ, এই আন্দোলন ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং ন্যায়ের পক্ষে। আমি চেষ্টা করছি, কীভাবে ন্যায়ের পক্ষে থেকে প্রশাসনকে আরও গতিশীল ও মানবিক করা যায়। জুলাইয়ের চেতনা আমাকে শিখিয়েছে প্রতিবাদ করতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং নৈতিকতা ধরে রাখতে। আমরা চাই এই চেতনা যেন আমাদের মধ্যে স্থায়ী হয়, এবং নতুন প্রজন্মও এই মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠে- যাতে অন্যায়, অবিচার ও দাম্ভিকতা দেশ থেকে দূর হয়।
আমি বিশ্বাস করি, শুধু রাজনৈতিক দল পরিবর্তন করলেই দেশ বদলায় না-নিজেকে বদলাতে হয়। আমাদের সবার ভিতরের পশুত্ব দমন করতে হবে। আমরা চাই ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা-সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি ন্যায়ভিত্তিক, আলোকিত ও উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। এই চেতনায় বিশ্বাস রেখে আমি কাজ করছি-শিক্ষা, গবেষণা, আন্তরিকতা ও সম্পর্কের পরিবেশকে উন্নত করে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে।
দ্যা ঢাকা ডায়েরি: আপনার দৃষ্টিতে একজন উপাচার্য হিসেবে ছাত্রদের অধিকার ও রাষ্ট্রের নীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা কতটা কঠিন? এই জায়গায় আপনি কীভাবে নেতৃত্ব দিতে চান?
আনোয়ারুল আজীম আখন্দ: সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান স্টেকহোল্ডার হল আমাদের শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা এসব শিক্ষার্থীর বিভিন্ন যৌক্তিক দাবি থাকে, যেগুলো সমাধানের চেষ্টা আমি সবসময় করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, চেয়ারম্যান, ছাত্রকল্যাণ দপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে পরামর্শ করে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যাই। যদিও সব দাবি পূরণ করা সম্ভব হয় না, কারণ আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। তবে আমরা চাই সবাই যেন যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক চিন্তা করে এবং অংশীদারিত্বমূলক পরিবেশে সমাধান খুঁজে পায়।
দ্যা ঢাকা ডায়েরি: আন্দোলন চলাকালীন বিশেষ কোনো ঘটনা কি আপনার এখনো মাঝেমধ্যে মনে পড়ে?
আনোয়ারুল আজীম আখন্দ: ৫ আগষ্ট বা ৩৬ জুলাইয়ের ঘটনাগুলো সত্যিই ভোলার মতো নয়। সকালে ১০টায় সাদা দলের শহীদ মিনারে একটি কর্মসূচি ছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে সেখানে যাওয়ার কথা থাকলেও, গোলাগুলির খবর পেয়ে আমরা কয়েকজন শিক্ষক রাজু ভাস্কর্যের দিকে রওনা হই। অপরাজেয় বাংলার সামনে গিয়ে দেখি আরও ২০-২৫ জন শিক্ষক জড়ো হয়েছেন। সেখান থেকে ব্যানারসহ আমরা রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান নিই। হঠাৎ শহীদ মিনার দিক থেকে পুলিশ দৌড়ে এসে জানায়, আমরা কারফিউ ভঙ্গ করেছি এবং দাঁড়াতে পারবো না। তর্ক-বিতর্কের পর পাঁচ মিনিট সময় পাই, কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা আমাদের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। এরপর আমরা ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবনের সামনে গিয়ে বসি, কিন্তু পুলিশ সেখানেও আমাদের বসতে দেয়নি।
রাজুতে দাঁড়ানোর সময় অনেক অচেনা শিক্ষার্থী বৃষ্টির মধ্যে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদের আমরা মাঝখানে জায়গা দেই। তখন কয়েক জন শিক্ষক বক্তব্য দেন। এরমধ্যেই পুলিশ আবার এসে ব্যানার কাড়ে নেয় এবং রুক্ষ আচরণ করে। আমরা বলি, ‘এটা আমাদের ক্যাম্পাস, আমরা চলে যাবো কেন?’, কিন্তু তারা তাতেও আমাদের সরে যেতে বলে। আশেপাশে অনেক সাংবাদিক ও টিভি ক্যামেরা ছিল।
পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা ভিসি চত্বরে সরে যাই এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপদে সরতে বলি। আমরা সেখানে এক-দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করি, আশঙ্কা করছিলাম শিক্ষার্থীদের উপর হামলা হতে পারে। ঠিক তখনই খবর পাই সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। আমরা শিক্ষকরা তখন আবার রাজুতে গিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। পরে দেখি লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তা নেমে পরেছে সেই মুহুর্ত টা আমার স্বরণীয়।
দ্যা ঢাকা ডায়েরি: জুলাই আন্দোলন শিক্ষার্থীদের মধ্যে কী ধরনের চিন্তাগত বা মানসিক পরিবর্তন এনেছে বলে আপনি মনে করেন?
আনোয়ারুল আজীম আখন্দ: আমি মনে করি, কী পরিবর্তন হয়েছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-কী পরিবর্তন হওয়া উচিত। যে আন্দোলন শিক্ষার্থীরা শুরু করেছিল, তাতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দিয়েছিল। এটি ছিল স্বৈরাচার, অন্যায় ও দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে গণজাগরণ।
আমি চাই, এই অন্যায়বিরোধী চেতনা তরুণ প্রজন্মের মনে সবসময় জাগ্রত থাকুক। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-মানসিকতার পরিবর্তন। কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ক্ষমতায় পৌঁছালেও যেন সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে আরেকটি অন্যায় না করে এবং নিজে যেন আবার স্বৈরাচার না হয়।
জুলাই আমাদের শেখায়-ন্যায়ের পক্ষে থাকতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে থাকতে হবে। আমি এই মানসিক পরিবর্তন নতুন প্রজন্মের মাঝে দেখতে চাই। দেশ বদলাতে হলে আগে নিজেকে বদলাতে হবে-এই বার্তাটাই সবার মধ্যে পৌঁছাক। যেন কারও মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাব জন্ম না নেয়।
দ্যা ঢাকা ডায়েরি: সবশেষে আপনার অভিজ্ঞতা থেকে আগামী দিনের শিক্ষার্থীদের জন্য কী বার্তা দিতে চান? বিশেষ করে গণতন্ত্র, নেতৃত্ব এবং ন্যায়বোধ নিয়ে।
আনোয়ারুল আজীম আখন্দ: সমাজে কেবলমাত্র কিছু মানুষ নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করে, সবাই পারে না। নেতৃত্বের গুণ অর্জন করতে হলে একজনকে হতে হয় সত্যবাদী, পরোপকারী, নৈতিক, জ্ঞানী। এজন্য প্রয়োজন দেশ-বিদেশের মনীষীদের জীবনী পাঠ, যাতে শেখা যায়-তারা কোন পরিস্থিতিতে কেমন আচরণ করেছেন। এই গুণগুলো অর্জন করে কেউ যদি ত্রুটি বাদ দিয়ে সততা ও বলিষ্ঠতা নিয়ে এগোয়, তবে নেতৃত্বের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ জ্ঞান বিতরণ করা। আমরা চাই, শিক্ষার্থীরা সেই জ্ঞান অর্জন করে কেউ গবেষণায়, কেউ নেতৃত্বে, কেউ বিশ্বমঞ্চে অবদান রাখুক। বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের অর্থ সরাসরি নেতৃত্ব তৈরির কারখানা না হলেও, এটি নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে-এটাই আমাদের লক্ষ্য।
টিডিডি/ এএইচআর