১১ জুলাই ১ম পুলিশি হামলার শিকার হন কুবি শিক্ষার্থীরা, বাধা ভেঙে ৬ ঘন্টা মহসড়কে প্রতিরোধ

নুরুল হাকিম বাপ্পি

কুবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১১ জুলাই ২০২৫, ১১:০৫

Thumbnail
ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের জুলাইয়ে চাকরিতে সকল ধরনের বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল ও ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে রাজপথে নামে ছাত্রসমাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সূচিত এই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ক্রমেই তা রূপ নেয় এক সর্বজনীন ছাত্র গণ-আন্দোলনে, যার পরিণতিতে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন ঘটে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের। কুমিল্লাতে আনদোলনের শুরু থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষার্থীরা

২০২৪ সালের ৪ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধের মধ্য দিয়ে কুমিল্লায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়। ১১ জুলাই বেলা ৩টার দিকে পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট হামলায় বহু শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক আহত হন। সেদিনের হামলা, টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট কিংবা লাঠিচার্জ কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি কুবি শিক্ষার্থীদের। রোদে-বৃষ্টি সত্ত্বেও রাত প্রায় ৬ ঘন্টা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা যা সারাদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিল।

প্রতিদিনের ধারাবাহিকতায় সেদিনও কুবি শিক্ষার্থীরা ন্যায্য দাবির পক্ষে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। মিছিলটি যখন ছাত্র আন্দোলন চত্বর (তৎকালীন আনসার ক্যাম্প) নামক স্থানে পৌঁছাতেই তাদের গতিরোধ করে পুলিশ বাহিনী। শিক্ষার্থীরা পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে সামনের দিকে অগ্রসর হতেই পুলিশ বাহিনী শুরু করে বর্বরোচিত হামলা। পুলিশ লাঠিচার্জ করে শিক্ষার্থীদের এলোপাতাড়ি পিটাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর শিক্ষার্থীরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে সমবেত হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছোঁড়ে টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট। এতে বহু শিক্ষার্থী আহত হন।

সেদিন শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় আবাসিক হলগুলোতে। হামলার প্রতিবাদে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল এবং সুনীতি-শান্তি হলের (তৎকালীন শেখ হাসিনা হল) শত শত আবাসিক ছাত্রী বিশাল মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। কুবির অগ্নিকন্যারা সেইদিন দেখিয়েছিল অভূতপূর্ব সাহসিকতা। 

তারা মুখে মুখে ধ্বনিত করছিল প্রতিবাদী স্লোগান: 'কোটা না মেধা? মেধা, মেধা', 'হামলা করে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না', 'আমার ভাই আহত কেন? প্রশাসন জবাব চাই' ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত হয় ক্যাম্পাস ও তার আশপাশ। একপর্যায়ে মিছিলকারীরা পুলিশের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তখন তারা 'ভুয়া, ভুয়া' স্লোগানে পুলিশি বাধা ভেঙে এগিয়ে যায় এবং পৌঁছে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। পরের দিন ১২ জুলাই তৎকালীন আনসার ক্যাম্পকে নামকরণ করে 'ছাত্র আন্দোলন চত্বর' নামকরণ করে শিক্ষার্থীরা।

সেদিন হামলার শিকার হওয়া বায়েজিদ হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী দ্যা ঢাকা ডায়েরিকে জানায়, 'আমরা প্রতিদিনের মতো কেন্দ্র ঘোষিত বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করতে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে যাচ্ছিলাম। দুপুর দুইটার সময় আমরা ক্যাম্পাস গেইট থেকে একটি ট্রাকে করে বিশ্বরোড অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমাদের হাতে পতাকা ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। ক্যাম্পাস গেইট থেকে ৩ মিনিটের রাস্তা ছাত্র আন্দোলন চত্বর পর্যন্ত যেতেই আমাদেরকে পুলিশ বাধা দেয়। 

তিনি আরো জানান, আমাদেরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। তারপর আমরা স্লোগান দিয়ে সামনে এগোতে চাই কিন্তু তারা আমাদেরকে এগোতে দিচ্ছিলো না। আমাদের আঘাত করবে, গুলি করবে এমন ভয় ভীতি দেখাচ্ছিল তারা। কিন্তু তাদের এই ভয়কে তোয়াক্কা না করে আমরা আরো জোরে স্লোগান দেওয়া শুরু করেছিলাম। আমরা যখন তাদের ব্যারিকেড ভাঙতে যাবো তখনই তারা আমাদের উপর অতর্কিতভাবে হামলা শুরু করে। লাঠিচার্জ করে, টিআরসেল নিক্ষেপ করে, এমনকি রাবার বুলেট পর্যন্ত ছুড়েছে তারা। তখন প্রায় ১৫ জনের মতো মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল। আমরা টিকতে না পেরে যখন পিছু হটে যাচ্ছিলাম তখনই বিশাল মিছিল নিয়ে হাজির হয় আমাদের বোনেরা। এরপর আর আমাদেরকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি।

সেদিনের হামলায় গুরুতর আহত হন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এমরান হোসেন। লাঠিচার্জের শিকার হয়ে তাঁর ডান হাত ভেঙে যায়। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ আমাদেরকে বাঁধা দেয়। আমরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সামনে যেতে চাইলে তারা আমাদের উপর লাঠিচার্জ শুরু করে। যেহেতু আমি সামনের সারিতে ছিলাম তাদের লাঠির আঘাতে আমি মাটিতে পড়ে যাই। মাঠি থেকে উঠতে চেষ্টা করছিলাম এমন সময় চতুর্দিক থেকে পুলিশ আমাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করছিল। ওখান থেকে পালিয়ে আমি পাশে বনের ভেতরে চলে গিয়েছিলাম। স্বৈরাচারের দোসরেরা ওখানে গিয়েও আমাকে আঘাত করে। পরে আমার কয়েকজন বন্ধু গিয়ে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।

তিনি আরো বলেন, 'সেদিন আমি পুলিশি হামলায় জ্ঞান হারিয়েছিলাম। আমার যখন জ্ঞান ফিরে তখন আমি কুমিল্লা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। আমাকে ৩ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিল।'

বিপ্লবী সুনীতি-শান্তি হলের আবাসিক শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা শান্তা স্মৃতিচারণ করে দ্যা ঢাকা ডায়েরি'কে জানায়, ছাত্র আন্দোলন চত্বরে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ হামলার খবর ফেসবুক লাইভে পেয়েছিলাম। তখনই আমরা হলের সকল মেয়েরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের ভাইদের উপর এমন বর্বরোচিত হামলায় সেদিন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল আমাদের। আমরা যাওয়ার পর পুলিশ আর আটকে রাখার দুঃসাহস দেখায়নি সেদিন।'

গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন 'চ্যানেল আই' এর কুবি প্রতিনিধি সৌরভ সিদ্দিকী। তিনি 'দ্যা ঢাকা ডায়েরি'কে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী এবং ক্যাম্পাস সাংবাদিক হিসেবে আমি সেদিন আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ আমাদের পথ আটকে দেয়। লাঠিচার্জ,  টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোঁড়ার ফলে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এই হামলায় আমার সহকর্মী, ক্যাম্পাস সাংবাদিক অনন মজুমদার, মাথায় রাবার বুলেটের আঘাতে গুরুতর আহত হন। 

তিনি বলেন, আমরা, ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা, তখন পুলিশের এই আচরণ এবং হামলার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর শিক্ষার্থীরা আবার সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে আসলে পুলিশ ফের টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। ঠিক তখনই আমার মাথায় একটি রাবার বুলেট এসে আঘাত করে। মুহূর্তেই আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। সেখান থেকে কয়েকজন শিক্ষার্থী আমাকে উদ্ধার করে পাশে একটি বাসার ভেতরে আশ্রয় দেন। পরে সেখান থেকে আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

 

টিডিডি/বিইউ