পুলিশ-ছাত্রলীগের ধাওয়ার মুখে খাল পাড়ি দিতে গিয়ে শহীদ হন শাবিপ্রবির রুদ্র সেন
প্রকাশিত: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৭:২৭

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণভ্যুত্থানে শহীদ হন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী রুদ্র সেন। নিয়মিত আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করতেন তিনি। বন্ধুবান্ধবকে ফোন ও ম্যাসেজ করে আন্দোলনে যোগ দিত্ব আহ্বান জানাতেন রুদ্র, বজ্রকণ্ঠে স্লোগানও দিতেন। শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত মিছিলের প্রথম সারিতেই ছিলেন রুদ্র সেন। পুলিশ ও ছাত্রলীগের (নিষিদ্ধ) হামলার পর নিরাপত্তার জন্য রুদ্রসহ চারজন খাল পার হতে কলাগাছের ভেলায় ওঠেন। সাতার না জানায় জীবন বাঁচাতে গিয়েই হারিয়ে যান রুদ্র রুদ্র সেন।
জানা যায়, রুদ্রসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী। দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলার সুবির সেন ও শিখা বণিক দম্পত্তির একমাত্র ছেলে। তার একমাত্র বোন সুস্মিতা সেন। তিনি হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। তিনি থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সুরমা আবাসিক এলাকার একটি মেসে।
পরিবার ও সহপাঠীরা জানায়, খুবই শান্ত প্রকৃতির রুদ্র কখনো রাজনৈতিক মিটিং মিছিলে যায়নি। তবে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সে মোটেও কার্পণ্য করেনি। শহীদ রুদ্র ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন দেশের সুনামধন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
যেভাবে শহীদ হন রুদ্র সেন:
১৮ই জুলাই শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে আন্দোলনে নামে সিলেটের ছাত্র-জনতা। সেদিন দুপুরে পুলিশ হঠাৎ করেই অতর্কিতভাবে হামলা চালায় শিক্ষার্থীদের উপর। ছড়রা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেলে মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। তারা আশ্রয় নেয় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন তপোবন, সুরমা, আখালিয়া, মদিনা মার্কেটসহ আশপাশ এলাকায়। পুলিশ সেসব এলাকায় গিয়েও শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সেই হামলায় বিকেলে যুক্ত হয়েছিল শাবিপ্রবি ও মহানগর ছাত্রলীগের (নিষিদ্ধ) নেতাকর্মীরা। তারা আবাসিক এলাকায় ঢুকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষে জড়ায়।
পুলিশ ও ছাত্রলীগ যখন সুরমা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে তখন চিন্তিত হয়ে পড়ে রুদ্রসহ তার সাথে থাকা সহপাঠীরা। তারা নিরাপত্তার জন্য নগরীর বাগবাড়ী এলাকায় যাওয়ার সময় কলা গাছের ভেলায় করে খাল পার হওয়ার চেষ্টা করে। সেই ভেলায় ছিল রুদ্রসহ চারজন। খালের মাঝখানে যাওয়ার পর ভেলা উল্টে যায়। বাকিরা উঠে আসলেও রুদ্র সাঁতার না জানায় তলিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে ওসমানি মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয়। ততক্ষণে মৃত্যুবরণ করেন রুদ্র সেন।
যা বলছেন বেঁচে ফেরা সহপাঠী :
শহীদ রুদ্রকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তার সহপাঠী ও জুলাই আন্দোলনে সহযোদ্ধারা। ভেলা থেকে বেঁচে ফেরা রুদ্রের বন্ধু আনন্দময় দত্ত আক্ষেপ করে বলেন, আমার বন্ধুর জন্য আমি কিছুই করতে পারলাম না। চোখের সামনে তাকে হারালাম, অথচ এখনও পর্যন্ত এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের কারও কোনো বিচার হয়নি। কেউ শাস্তি পায়নি।
তিনি আরও বলেন, রুদ্র আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে। রুদ্রকে স্মরণীয় করে রাখতে আমরা চেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্থাপনার নাম তার নামে করা হোক। তবে এই ব্যাপারে প্রশাসনের কোন আগ্রহ দেখছি না। রুদ্রের পরিবার ও একমাত্র ছেলে সন্তানকে হারিয়ে অসহয়ায় হয়ে পড়েছে। তার পরিবারের পাশেও কেউ দাঁড়াচ্ছে না।
যা বলছেন সহযোদ্ধারা:
স্মৃতিচারণ করেন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স (সিইপি) বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী আল-আমিন। তিনি বলেন, আমিও আমার কয়েকজন বন্ধুসহ নিয়মিত তার সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিতাম। একেবারে প্রথম দিকে (৩ জুলাই) থেকেই রুদ্র আমাদের ফোন করে, ম্যাসেজ করে আন্দোলনে ডাকত। সে সবসময় মিছিলের সম্মুখভাগে থাকত। আন্দোলনের মাঝখানে প্রায়ই তার সঙ্গে আমার খুনসুটিতে ভরে উঠত সময়গুলো। সেই দিনগুলো এখন মনে পড়লে বুকের ভেতর কেমন যেন হাহাকার জেগে ওঠে।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা যেদিন ছাত্রদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে সম্বোধন করেন, সেদিন রাতে সে আমাকেসহ কয়েকজনকে মিছিলে যোগ দিতে বলে। আমরা সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে মিছিলে গিয়েছিলাম। আর সকলে মিলে একসাথে বজ্রকণ্ঠে স্লোগান দিয়েছিলাম ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার রাজাকার।’
আল আমিন বলেন, তার শহিদ হওয়ার পরদিন আন্দোলনে গিয়েছিলাম। চারপাশে ভিড় ছিল, পরিচিত মুখ, পরিচিত স্লোগান কিন্তু রুদ্র ছিল না। মনে হয়েছিল পাশে দাঁড়ানো ছায়াটাই হারিয়ে গেছে। নিজের মাঝে তখন এক ভয়ানক শূন্যতা টের পেয়েছিলাম। আজও সেই মুহূর্তগুলো মনে পড়লে শরীর কেঁপে ওঠে।
রুদ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আসিফ রাইহান জিম স্মৃতিচারণ করে বলেন, রুদ্র ছিল পরোপকারী। কারো কোনো বিপদ-আপদ দেখলেই পাশে দাঁড়াতো নিঃসংকোচে। এমন বন্ধু পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
সিলেটের আন্দোলনের সম্মুখ সারির জুলাই যোদ্ধা ও কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক ফয়সাল হোসাইন বলেন, ‘শাবিপ্রবিতে আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই শহিদ রুদ্র শুধু মাত্র সক্রিয় নয় ছিলেন সংগঠকের ভূমিকায়। প্রতিটি মিছিলে প্লেকার্ড হাতে একদম সামনের সাড়িতে থাকতো। মিছিলের পাশাপাশি ১৮জুলাই শহিদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অনলাইনে তৎপরতা ও বন্ধুদের আন্দোলনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল ব্যাপক।