সাংবাদিক আমজাদ হোসেনের বিশ্লেষণ

ডাকসুর ব্যালট বিতর্ক : অনুসন্ধানে যা পেলাম

প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২:৩৪

Thumbnail
আমজাদ হোসেন হৃদয়। ছবি - টিডিডি সম্পাদিত

ডাকসুর ব্যালট সরবারাহের কাজ করেছে মূলত দু'টি প্রতিষ্ঠান। আনজা কর্পোরেশন এবং এমআরএন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। 

ডাকসুতে মোট ভোটার সংখ্যা ৩৯ হাজার ৮৭৪। ডাকসু ও হল সংসদ মিলিয়ে একজন ভোটারের জন্য প্রয়োজন ৬টা ব্যালট পেপার। সে অনুযায়ী মোট ব্যালট পেপার প্রয়োজন ২ লাখ ৩৯ হাজার ২৪৪।

আনজা কর্পোরেশন News 24 কে জানিয়েছে তারা ১লক্ষ ৫৩ হাজার ব্যালট ছাপানোর কাজ করেছে। অর্থাৎ তাহলে দাঁড়ায় বাকি ৮৬ হাজার ২৪৪টি ব্যালট ছাপায় এমআরএন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। 

এমআরএন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডই মূলত নীলক্ষেতে ব্যালট ছাপায়, যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবগত করা হয়নি। তারা নীলক্ষেতে মোট ব্যালট ছাপিয়েছে ৮৮ হাজার। 

এবার আসি ৮৮ হাজারের আলোচনায়। নীলক্ষেতে ব্যালটের কাজ করা হয় দুইটা দোকানে, জালাল প্রিন্টার্সে ছাপানোর কাজ আর মক্কা পেপার এন্ড কাটিং ঘরে কাটিংয়ের কাজ করা হয়। ২২ রিম কাগজ থেকে ৮৮ হাজার ব্যালট ছাপানো হয়। প্রতিটি রিমে ৫০০ শিট ছিল, ফলে মোট ১১ হাজার শিট ছিল। প্রত্যেকটা শিটের সাইজ ছিলো ২৩×৩৬ ইঞ্চি, যেগুলো কেটে ১১.৫×১৮ ইঞ্চি করা হয়। একেকটি শিট থেকে চারটি ব্যালট তৈরি করা হয়। ১১ হাজার শিট কেটে ৪৪ হাজার ব্যালট প্রস্তুত হয়। তখন প্রত্যেকটায় দুইটা করে থাকে। এরপর জালালের দোকানে প্রিন্টিং করা হয়। প্রিন্টিং শেষে ব্যালটগুলো শুকিয়ে দ্বিতীয় ধাপে আবার কাটিং করা হয়, ফলে সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৮ হাজার। 

News 24 এর সাক্ষাৎকারে জালালকে প্রতিবেদক বলেছিলেন ৯৬ হাজার কি-না। তখন সে বলেছিল ঐরকমই।  তবে হিসেবে ৯৬ হাজার পাওয়া যায়নি। জালালও পরে জানায় তাকে কনফিউজড করা হয়েছিল। কিন্তু জালালের পরের সাক্ষাৎকার এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মতে ২২ রিম অর্থাৎ ৮৮ হাজার ব্যালটের কাজ করা হয়েছিল।

ব্যালট ৫ ধাপে তৈরি হয়। প্রথমে ছাপানো, একুরেট মাপে কাটিং করা, কোডিং বসানো, প্রি-স্ক্যান করা এবং সর্বশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের স্বাক্ষর ও সীল নেওয়া হয়। শুধুমাত্র প্রথম দুই ধাপ তারা নীলক্ষেতে করেছে। এতে সিকিউরিটি কোড থাকে তাই এটি নকল করা সম্ভব না।

মূলত মেশিনে সমস্যা থাকায় নির্ধারিত সময়ের ভিতরে ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হবে না ভেবে তারা দ্রুত কাজ করার জন্য নীলক্ষেত জালাল প্রেসে ব্যালট ছাপায়। নির্ধারিত ব্যালট ডেলিভারি দেওয়ার পর যে ব্যালট ছিল সেগুলো তারা নষ্ট করে ফেলে।

এখানে মূল সমস্যাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে তারা নীলক্ষেতে ছাপানোর বিষয়টি জানায়নি। এটি জানালে এই বিতর্কটা তৈরি হতো না। না জানার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীলক্ষেতে ছাপানোর সুযোগ নেই বিবৃতি দেয়। স্বাভাবিকভাবে নীলক্ষেতের কোনো দোকানে ব্যালট প্রস্তুতের কোডিংসহ ৫টি ধাপ সম্পন্ন করা সম্ভব না।
পরে নীলক্ষেতে ছাপানোর বিষয়টি জানার পর এই প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখা চেয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা সেই ব্যাখা সম্ভবত দিয়েছেনও।

তবে এসব বিষয়ে প্রশাসনের উচিত আরও স্পষ্ট ব্যাখা দেওয়া। যাতে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ না থাকে। প্রার্থীরাও সেটা চেয়েছেন। নির্বাচন কমিশন শিগগিরই সংবাদ সম্মেলন বা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট ব্যাখা দিবেন বলে জানতে পেরেছি।

এদিকে আবার ডাকসুতে নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত করে পুনরায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজনের দাবি জানান তাঁরা।

তবে, ভোটের দিন দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপিপন্থী রিটার্নিং অফিসাররা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের ভাষ্য, মোটাদাগে কোন অনিয়ম ধরা পড়েনি তাদের চোখে। নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তাঁদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। কেউই কারচুপি বা অনিয়ম দেখেননি বলে জানিয়েছেন।
 
আজ এক সংবাদ সম্মেলনে ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংক জানিয়েছে, ডাকসুতে ১০ জন রিটার্নিং অফিসারের মধ্যে ৮ জনই ছিলেন সাদা দলের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের মধ্যে ১৬টি হলের প্রাধ্যক্ষই সাদা দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত। এছাড়াও, অধিকাংশ হলের রিটার্নিং অফিসারগণও সাদা দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। 

সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা বলেন, নির্বাচন পরিচালনার অধিকাংশ দায়িত্ব যখন সাদা দলের শিক্ষকদের হাতে ছিলো; তখন নিজেদের বিবৃতিতে দাবী করা নির্বাচনে 'জালিয়াতি ও অনিয়ম' প্রসঙ্গটি এটি দ্বিচারিতা ও দ্বিমুখী আচরণের পর্যায়ে পড়েছে।

 

আমজাদ হোসেন হৃদয়, নিজস্ব প্রতিবেদক

দৈনিক কালবেলা